লেখা: রোকনুজ্জামান রিপন
![](https://www.blogger.com/img/transparent.gif)
আমরা জানি ক্যান্সার বা কর্কটরোগ হল আমাদের অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন বা টিউমার সংক্রান্ত রোগ। এখনও পর্যন্ত এই রোগের উল্লেখযোগ্য ঔষধ আবিষ্কার করা যায়নি। কারণ ক্যানসার কেন হয় আমরা আজো জানিনা।এটা যেন স্বয়ং মৃত্যু যার কারন প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ সহজে ধরা পড়ে না, ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোন চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয় না। পৃথিবীতে ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেক ক্যান্সারই আলাদা আলাদা।একটার সাথে আরেকটার কোন মিল নেই।থকলেও সামান্য। বর্তমানে ক্যান্সার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে নতুন নতুন অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
ক্যানসার নিয়ে গবেষনা করতে গেলে আমাদের প্রথম প্রশ্ন আসে ক্যান্সার কী ?
তারপরে প্রশ্ন আসে এর কারন কি?
তারপরে ভাবনা আসে কোন কোন লক্ষন দেখা দিলে ক্যান্সার বলব।
চলুন প্রথমেই ক্যান্সার কাকে বলে সেটা নিয়েই আলোচলা করি। আমরা জানি প্রতিনিয়ত আমাদের দেহের কোষের মৃত্যু হচ্ছে আবার সাধারনভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দিচ্ছে। সাধারনভাবে বলতে গেলে যখন এই কোষগুলো কোনও কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একেই টিউমার বলে।শুরু হয় সমস্যা। এই টিউমার বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে।হতে পারে বিনাইন। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলে। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনক্ষম হয়ে বৃদ্ধি পাওয়া কলাকে নিওপ্লাসিয়া (টিউমার) বলে, এবং সেই রকম ক্রিয়া যুক্ত কোষকে নিওপ্লাস্টিক কোষ বলে। নিওপ্লাস্টিক কোষ আশেপাশের কলাকে ভেদ করতে না পারলে তাকে বলে নিরীহ বা বিনাইন টিউমার। বিনাইন টিউমর ক্যান্সার নয়। নিওপ্লাসিয়া কলা ভেদক ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার, এবং তার অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনক্ষম ভেদক ক্ষমতাযুক্ত কোষগুলিকে ক্যান্সার কোষ বলে। অনেক ক্যান্সার প্রথমে বিনাইন টিউমার হিসাবে শুরু হয়,কিন্তু তার পরে তার মধ্যেকার কিছু কোষ পরিবর্তিত (ট্রান্সফর্মেসন) হয়ে ম্যালিগন্যান্ট (অর্থাৎ ভেদক ক্ষমতাযুক্ত) হয়ে যায়। তবে বিনাইন টিউমার ক্যান্সারে পরিবর্তিত হবেই তার কোন স্থিরতা নেই। কিছু বিনাইন টিউমার সদৃশ ব্যাধি আছে যাতে ক্যান্সার হওয়া অবশ্যম্ভাবী - এদের প্রি-ক্যান্সার বলে। নামে বিনাইন অর্থাৎ নিরীহ হলেও বিনাইন টিউমার কিন্তু নিরিহ নয়,কেননাআশেপাশের কোষগুলোকে সে ক্ষতি করে। মেটাস্ট্যাসিস হলো ক্যান্সারের একটি পর্যায়, যাতে ক্যান্সার কোষগুলি অন্যান্য কলাকে ভেদ করে ও রক্ত, লসিকাতন্ত্র (Lymphatic System) ইত্যাদির মাধ্যমে দূরবর্তী কলায় ছড়িয়ে যায়। স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর যদি আমরা ধুমপান করি তাহলে অন্যথায় এটি নাও হতে পারে ।
এর পরে আমরা বুঝতে চেষ্টা করব ক্যান্সারের কারণটা আসলে কি?
যদিও ঠিক কি কারণে ক্যান্সার হয় সেটা এখনও নিশ্চিত করে আমরা জানিনা। তবে সাধারণ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে।
যেমন;
১)বয়স:
সাধারণত বয়স যত বাড়তে থাকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত বাড়তে থাকে।এর একটা কারণ হল এ সময়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
২)খাবার এবং জীবনযাপনের ধারা:
খাবার এবং জীবনযাপনের ধারা ক্যান্সারের বড় একটি প্রভাবক।
যেমন, ধুমপান বা মদ্যপানের সাথে ফুসফুস, মুখ ও কণ্ঠনালীর এবং যকৃৎ বা লিভারের ক্যান্সারের যোগাযোগ রয়েছে। তেমনই ভাবে পান-সুপারি, জর্দা, মাংস, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ইত্যাদি খাবারের সাথেও ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। যারা সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম কম করে তাদের মধ্যেও ক্যান্সারের প্রবণতাটা বেশি।
৩)পারিবারিক ইতিহাস:
ক্যান্সার হওয়ার আরেকটা প্রধান কারন হচ্ছে জিনগত সমস্যা। বংশক্রমে ক্যান্সারের জীবাণু বহন করা জিন একসময় প্রকট হয়।যার ফলে দেখা দেয় এই ভয়ংকর রোগটা।
৪)পরিবেশ এবং পেশাগত কারণ
রাসায়নিক পদার্থের সাথে ক্যান্সারের অনেক বড় একটা সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, জমেসোথেলিওমিয়া-তে (এক ধরনের দূর্লভ ক্যান্সার, এতে ফুসফুসের চারপাশ এবং পেটের দিকের কোষগুলো আক্রান্ত হয়) আক্রান্তদের ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই এসবেস্টস ধাতুর সংস্পর্শে আসার কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। সাধারণত জাহাজ তৈরির শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের এই ধাতুর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনাটা বেশি থাকে। এই কারণেই অনেক দেশে এই ধাতুর ব্যবহার নিষিদ্ধ। একইভাবে রঙের কারখানা, রাবার বা গ্যাসের কাজে যারা নিয়োজিত তারা এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে মুত্রথলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে অনেক দেশে এসব রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরিবেশগত কারণের অন্যতম একটা হচ্ছে সূর্য। রোদে বেশিক্ষণ থাকার কারণে ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তেজস্ক্রিয়তার কারণেও বিভিন্ন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ:
মানবদেহে যে সকল স্থানে ক্যান্সার ধরা পড়েছে তা হল প্রস্টেট গ্রন্থি, স্তন, জরায়ু, অগ্ন্যাশয়, রক্তের ক্যান্সার, চামড়ায় ক্যান্সার ইত্যাদি। একেক ক্যান্সারের জন্য একেক ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণ হচ্ছে:
খুব ক্লান্ত বোধ করা
[ক্ষুধা] কমে যাওয়া
শরীরের যে কোনজায়গায় চাকা বা দলা দেখা দেয়া
দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ভাঙা
মলত্যাগে পরিবর্তন আসা (ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের সাথে রক্ত যাওয়া)
জ্বর, রাতে ঠান্ডা লাগা বা ঘেমে যাওয়া
অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমা
অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া
ত্বকের পরিবর্তন দেখা যাওয়া
মানসিক অস্বস্তি
বেশ কিছু ক্যান্সারের নাম:
হাইপারপ্লাসিয়া (hyperplasia) =কলায় কোষের সংখ্যাধিক্য (হাইপার= অধিক, ~প্লাসিয়া= মোটামুটিভাবে কলায় কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি বা কোষীয় বৈশিষ্ট্য)
মেটাপ্লাসিয়া (metaplasia= একরকম কলার অন্যরকম কলায় পরিবর্তন
টিউমার (Tumor, অর্বুদ)= স্ফীতি (গ্রিক ভাষায়)। পূর্বে প্রদাহ জনিত স্ফীতিকেও টিউমার বলা হত। তবে এখন টিউমার বলতে নিওপ্লাসিয়া বোঝায়।
(সাধারণতঃ সব টিউমরের নামের শেষে ~ওমা অনুসর্গ থাকে, যেমন (মেলানোমা, লাইপোমা), ও শুরুর অংশে কলার উৎস সম্বন্ধে নির্দেশ থাকে।)
নিওপ্লাসিয়া (neoplasia)= অনিয়ন্ত্রিতভাবে বর্ধনশীল কলা (নিয়ো~ = নতুন)
হ্যামারটোমা (Hamartoma = কলার কোষগুলি এককভাবে স্থানীয় বিশেষীভবন লাভ করলেও সমবদ্ধভাবে কলার ত্রিমাতৃক স্থাপত্য সঠিকভাবে দেওয়ার বদলে জট পাকিয়ে যায়। (অর্থাৎ কোষীয় সংখাবৃদ্ধি খুব একটা অনিয়ন্ত্রিত না হলেও কলাসংগঠন অনিয়ন্ত্রিত)
ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমার (malignant) = অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনক্ষম এবং ভেদন ক্ষমতাযুক্ত টিউমার = ক্যান্সার
ক্যান্সার মানে কাঁকড়া (সংস্কৃত কর্কট)। স্থানীয় কলা ভেদ করে ম্যালিগ্ন্যান্ট টিউমর যখন অনেক শুঁড়ের মত মাইক্রোমেটাস্টাসিস সম্প্রসারিত করে তখন তাকে দেখতে অনেকটা দাঁড়া-ওয়ালা কাঁকড়ার মত দেখায়।
অ্যানাপ্লাসিয়া (anaplasia) = কলার অপ-বিশেষীভবন (ডি-ডিফারেন্সিয়েশন), অর্থাৎ কলা আগের বিশেষীভূত কলা-বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ভ্রুণীয় বা প্রাক-কলার মত আচরণ করতে থাকে। অ্যানাপ্লাস্টিক অর্থাৎ অ্যানাপ্লাসিয়া-যুক্ত ক্যান্সার সাধারাণতঃ বেশি ক্ষতিকর।
কার্সিনোমা = আবরণি কলা (Epitheilum) উৎসের ক্যান্সার
সার্কোমা = সংযোগ কলা (মেসেনকাইম) উৎসের ক্যান্সার
কলার উৎস অনুসারে ক্যান্সারের প্রকার
কার্সিনোমা
এটা খুব সাধারণ ধরনের ক্যান্সার। ফুসফুস, মলদ্বার, স্তন এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার এর অন্তর্ভুক্ত।
সার্কোমা
সাধারণত হাড়ের, কশেরুকা, চর্বি বা মাংসপেশির ক্যান্সারকে সার্কোমা বলে।
লিম্ফোমা
আমাদের শরীর জুড়ে লিম্ফ নোড ছড়ানো রয়েছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই লিম্ফ নোডের সাথে জড়িত। লিম্ফ নোডের ক্যান্সারকেই লিম্ফোমা বলে।
লিউকেমিয়া
রক্ত কোষের ক্যান্সারকেই লিউকেমিয়া বলে। এই রক্তকোষগুলো হাড়ের মজ্জা থেকে জন্ম নেয়।
No comments:
Post a Comment