ব্যাকটিরিয়া থেকে তৈরী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াবিহীন ওষুধ দিয়ে কি ভাবে ক্যান্সারের মোকাবিলা করা যায় এবং সেই চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমানে তাঁর গবেষণায় কতদূর সফল হয়েছে, তা নিয়ে বলছেন ইলিনয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েরঅধ্যাপক আনন্দ মোহন চক্রবর্তী। তাঁর ইন্টারভিউ নিয়েছে বোস ইনস্টিটিউটের গবেষক ডঃ স্বাগতা ঘোষ।
প্রশ্নঃ ক্যান্সার আসলে কি?
আমরা জানি,
ক্যান্সার হল একটি টিউমার যা আমাদের শরীরের যে কোন অংশেই হতে পারে। আমাদের শরীরে কোটি কোটি কোষ আছে। মানুষ জন্মানোর পর ছোট শিশু থেকে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের আকারও বাড়তে থাকে। কিন্তু মোটামুটি ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সের পর শরীরের আকার আর বাড়েনা। কোষ বিভাজন পদ্ধতিতে আমাদের শরীরের এই আকার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় যখন কোন পরিবর্তন হয় কোন কোষের বৃদ্ধি থেমে না গিয়ে ক্রমাগত বিভাজিত হতে থাকে। এইপরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই কোষের ডি.এন.এ (DNA) – তে হয়, এবং একে বলে মিউটেশান। এর ফলে অনিয়ন্ত্রিত বিভাজিত কোষের একটি পিণ্ড তৈরি হয় যাকে বলে টিউমার। এই টিউমার তাড়াতাড়ি বাড়তে গিয়ে পাশের সুস্থ কোষ থেকে খাবার নিতে শুরু করে। ফলে পাশের অনেক সুস্থ কোষ তখন মরে যেতে থাকে আর তার প্রভাব শরীরে পড়ে। একেই ক্যান্সার বলে।
অনিয়ন্ত্রিত বিভাজিত কোষের একটি পিণ্ড তৈরি হয় যাকে বলে টিউমার।
আমি আজ ক্যান্সার চিকিৎসার একটা পদ্ধতি নিয়ে কথা বলবো। তার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১২০ বছর আগে। ১৮৯২ সাল নাগাদ নিউইয়র্কে মেমরিয়াল হসপিটালের ক্যান্সার বিশারদ ডাক্তার উইলিয়াম কলি(William Bradley Coley)ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন যে যখন কোন ক্যান্সার রুগীর কোন ব্যাকটিরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হয় তখন ক্যান্সারের টিউমারগুলো কমে যায়। কিন্তু তিনি যখন সালফার ওষুধ দিয়ে সংক্রমণটা সারিয়ে দিতেন(অ্যান্টিবায়টিক তখনও আবিষ্কার হয়নি) তখন দেখলেন ক্যান্সার আবার পুরোপুরি ফিরে আসে। তখন উনি ভেবে দেখলেন যে ব্যাকটিরিয়ারা হয়তো
উইলিয়াম কলি। (উৎস)
ক্যান্সারের কোষগুলোকে মেরে ফেলতে পারে। এর পরের বেশ কিছু বছর তাই ক্যান্সার কমানোর জন্য ব্যাকটিরিয়া ইঞ্জেকশান করার পদ্ধতিতে চিকিৎসার চল হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা হল যে এমনিতেই শরীরে ক্যান্সারের কারণে ইমিউনিটি কমে যায় (দেহের ইমিউন কোষগুলো ক্যান্সার কোষদের চিনে জব্দ করতে ব্যস্ত!), সেক্ষেত্রে ব্যাকটিরিয়া ইঞ্জেকশান দিলে ইমিউনিটি অতি সক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতি স্বরূপ শরীর আরো দুর্বল হয়ে যায় ও রুগী মারা যায়।
যখন কোন ক্যান্সার রুগীর কোন ব্যাকটিরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হয় তখন ক্যান্সারের টিউমারগুলো কমে যায়।
এই ভাবনায় ভর করে আমাদের মনে হল যে এই ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণে ক্যান্সার কমে যাওয়ার পদ্ধতিটা বিশদভাবে জানা দরকার। ব্যাকটিরিয়ারা ঠিক কোন অস্ত্র দিয়ে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধটা করে সেটা জানা প্রয়োজন। তা জানতে গিয়ে দেখা গেল যে কয়েক জাতির ব্যাকটিরিয়া ক্যান্সারের কোষ দেখলেই কিছু প্রোটিন নিজেদের কোষ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয় ক্যান্সার-কোষের সাথে মোকাবিলা করার জন্য । এদের অ্যান্টি-ক্যান্সার প্রোটিন বলে। এই প্রোটিনগুলি ক্যান্সার কোষের মধ্যে ঢুকে যেসব প্রোটিন ক্যান্সার বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে তাদের ধ্বংস করে। কিন্তু এই অ্যান্টিক্যান্সার প্রোটিন কোন সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে না (কি ভাবে এই ব্যাকটিরিয়া ক্যান্সার এবং সুস্থ কোষের পার্থক্য নির্ণয় করে, তা কিন্তু এখনো বৈজ্ঞানিকদের কাছে একটা রহস্য!)। সুতরাং এই অ্যান্টিক্যান্সার প্রোটিন ব্যাকটিরিয়া থেকে বার করে পরিশুদ্ধ করে সেটি ক্যান্সারের চিকিৎসার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার । কিন্তু প্রোটিন পরিশুদ্ধকরণ(Purification) অনেক সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। USFDA (United States Food and Drug Administration)-র সঠিক নিয়মাবলী মেনে তা করতে হয়। সুতরাং এবার জানার দরকার পড়ল যে ঐ ক্যান্সার প্রতিরোধক বৈশিষ্ট্য প্রোটিনটির কোন নির্দিষ্ট অংশে আছে। প্রোটিন হল অ্যামিনো অ্যাসিডের লম্বা শৃঙ্খল। সুতরাং প্রোটিনের ঐ নির্দিষ্ট অংশটিকে বা পেপটাইডকে কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষ করতে পারলেই তা কার্যকরী ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পেপটাইড সংশ্লেষ অনেক কম সময়ে কম অর্থব্যয়ে করা যায়।
এই ধরণের কার্যকারিতা সম্পন্ন প্রোটিনটির নাম হল অ্যাজুরিন(Azurin)। যা সিউডোমোনাস ব্যাকটিরিয়া থেকে সংশ্লেষ করা হয়েছে। ১২৮টি অ্যামিনো অ্যাসিড সমন্বিত এই অ্যাজুরিন প্রোটিন থেকে মাত্র ২৮টি অ্যামিনো অ্যাসিড সমন্বিত নির্দিষ্ট যেপেপটাইড শৃঙ্খলটি ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার নাম পি২৮( P28)।
অ্যাজুরিনের মত আরেকটি প্রোটিন ল্যায(Laz) চিহ্নিত করা হয়েছে। যেটি গ্লিওব্লাস্টোমা( Glioblastoma) বা ব্রেন টিউমার এর ক্ষেত্রে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রোটিনটি ব্রেনের অসুখ মেনিনজাইটিস( Meningitis) সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া Niesseria meningitidesথেকে সংশ্লেষ করা হয়েছে। যেহেতু ব্রেন খুবই সুরক্ষিত অংশ তাই সহজে কোন ওষুধ ব্লাড-ব্রেন বেরিয়ার( blood-brain barrier) অতিক্রম করতে পারেনা। কিন্তু ল্যায প্রোটিন যেহেতু ব্রেনের অসুখ সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া থেকেই সংশ্লেষিত সেহেতু এই প্রোটিনের পেপটাইডকে ব্রেন টিউমারের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করলে সহজেই তা ব্লাড-ব্রেন বেরিয়ার অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।
সূত্রঃ
ডঃ আনন্দ মোহন চক্রবর্তী
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়েস এর ডিপার্টমেন্ট অফ মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনলজির বিশিষ্ট অধ্যাপকের সাক্ষাতকার থেকে।
No comments:
Post a Comment